আফগানিস্তানে কেন নারীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন?

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দেশটিতে দশ লাখের বেশি মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে। জামিলার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো ১২ বছর বয়সে। পরিবার তার জন্য যে পাত্রকে ঠিক করেছিলো – জামিলা (ছদ্ম নাম) তার জন্য ছয় বছর ধরে অপেক্ষা করেছে।

“সে তার বোন আর মাকে নিয়ে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো। ছয় বছর পর আমি তো আর আগের মতো খুকি নই। কিন্তু সে এতদিন পরে বলছে, যে সে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান চায় না। কারণ সে চায়না কেউ জানুক আমি তার স্ত্রী”, বলছিলেন জামিলা।

তার মনে হয়েছে এই ছেলেটি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

“আমি আর বেঁচে থাকতে চাইনি। তাই ইঁদুর মারার বিষ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম।”

তার মা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং সেখানে চিকিৎসার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

শুধু ২০১৭ সালেই চোদ্দশ নারী সেখানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন।
এটি আফগানিস্তানের একটি মাত্র ঘটনা । হেরাতের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের হিসেবে শুধু ২০১৭ সালেই আঠারোশ’ মানুষ সেখানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন। এর মধ্যে চোদ্দশ’ই নারী।

আত্মহত্যায় মৃত্যু হয়েছে ৩৫ জনের। এই সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

২০১৬ সালে এক হাজারের মতো মানুষের আত্মহত্যার চেষ্টা রেকর্ড করেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

শুধু হেরাত প্রদেশের নয়, পুরো আফগানিস্তান জুড়েই এমন প্রবণতা লক্ষণীয় বলে জানিয়েছে আফগান ইন্ডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশন।

তারা বলছে, দেশটিতে বছরে তিন হাজারের মতো মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে – যার আশি শতাংশই নারী।

তবে হেরাতেই এর অর্ধেক ঘটনা ঘটছে। এই সংখ্যা বেশিও হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আফগানিস্তানের মতো রক্ষণশীল সমাজে অনেক ঘটনা হয়ত পুলিশ বা হাসপাতাল পর্যন্ত গড়ায় না।

কিন্তু কেন মেয়েরা এই পথ বেছে নিচ্ছেন?

দারিদ্র, অধিকারের অভাব আর বেকারত্ব বিষয়টিকে আরো খারাপ পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
জোর করে বিয়ে দেয়া

এটি সম্ভবত একটি কারণ। আফগান ইন্ডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশনের হাওয়া আলম নুরিস্তানি বলছেন, “জোর করে বিয়ে দেয়া, পারিবারিক নির্যাতন, মানসিক সমস্যাসহ বহুবিধ কারণে আফগান নারীরা মারাত্মক চাপে রয়েছে। হেরাত হল বড় প্রদেশ এবং একটু সেকেলে”

আফগানিস্তানে মানসিক রোগ সম্পর্কে সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই।

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দেশটিতে দশ লাখের বেশি মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে।

আর বারো লাখ মানুষ উদ্বেগজনিত ব্যাধিতে ভুগছে।

৪০ বছর ধরে সশস্ত্র সংঘাত চলছে দেশটিতে। মানসিক ব্যাধি সেখানে প্রাধান্য পায়না।

তাই সেখানে আসল সংখ্যা বের করা মুস্কিল। সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা মাত্রা ভয়াবহ হয়ত সেটিও একটি কারণ।

জাতিসংঘের হিসেবে অন্তত ৮৭ শতাংশ আফগান নারী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং যৌন সহিংসতার শিকার।

তবে জোর করে বিয়ে দেয়াকে আত্মহত্যার একটি বড় কারণ মনে করা হচ্ছে।

দেশটির এক তৃতীয়াংশ মেয়েরই ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায়।
যার মাধ্যমে অসুখী বিয়ে থেকে হয়ত মুক্তি পেতে চেয়েছেন এই নারীরা।

নুরিস্তানি বলছেন, “নারীদের আত্মহত্যার মুল কারণই হল নির্যাতন। যেমন ধরুন জোর করে বিয়ে দেয়া। তার কোন মতে গুরুত্ব না দেয়া। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া”

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, দেশটির এক তৃতীয়াংশ মেয়েরই ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায়।

আর এসব কারণের পাশাপাশি দারিদ্র্য একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

ইঁদুর মারা বিষের সহজলভ্যতা

এটিও সম্ভবত একটি বড় কারণ। হেরাতের চিকিৎসকেরা বিবিসিকে জানিয়েছেন গত এক বছরে যারা আত্মহত্যার চেষ্টায় সফল হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিজেকে গুলি করা, কোন ঔষধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাবহার বা ওভারডোজিং এবং ইঁদুর মারা বিষ।

আগে নিজের গায়ে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া ছিল প্রধান পদ্ধতি।

হেরাতের প্রধান হাসপাতালের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিক সিরাজি বলছেন, “গত কয়েক বছরে পশু চিকিৎসকদের ব্যবহৃত ঔষধ বা ইঁদুর মারা বিষ অনেক বেশি সাধারণ মানুষজনের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। যেকোনো দোকানে গেলেই পাওয়া যাচ্ছে”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার ২০১৭ সালের স্বাস্থ্য গবেষণা কীটনাশক বা এমন বিষ দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছে।

ভারতেও দরিদ্রদের মধ্যে আত্মহত্যায় এমন বিষ ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে।

জাতীয় পরিকল্পনা

আত্মহত্যা প্রবণতা ঠেকাতে আফগানিস্তানে পুরো দেশব্যাপী ব্যবস্থা না নিলে তা রোধ করা যাবে না বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

৪০ বছর ধরে সশস্ত্র সংঘাত চলা দেশটিতে মানসিক ব্যাধি প্রাধান্য পায়না।
ডঃ নাবিল ফাকিরিয়ার তাদের একজন। তিনি বলছেন, “দেশব্যাপী একটি পরিকল্পনা নিতে হবে এবং আত্মহত্যার কারণগুলোকে স্বীকৃতি দিতে হবে”

কাবুলে আফগান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, এরকম একটি জাতীয় পরিকল্পনা তারা হাতে নিয়েছেন।

দেশটির সহকারী স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিদা মোহাম্মদ পাইকান স্বীকার করেছেন, আত্মহত্যা দেশটির জন্য একটি সমস্যা ।

তিনি বলছেন, “আপাতত উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেটির উপর ভিত্তি করে কর্মপন্থা ঠিক করা হবে”

আর হাওয়া আলম নুরিস্তানি বলছেন, কোথায় গেলে সাহায্য পাওয়া যাবে তা মানুষকে আরো বেশি করে জানাতে হবে।